আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান এক চমকপ্রদ ঘটনা । ঐতিহাসিক V.A. Smith এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, ” The invasion of India by Alexander the Great in 327 B.C . is more interesting than any other episode of early Indian History.
আলেকজান্ডার ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপের পুত্র । বাল্যকালে তিনি বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের কাছে গৃহশিক্ষা লাভ করেন। তবে আলেকজান্ডার এরিস্টলের দর্শন শাস্ত্র অপেক্ষা মহান বীরযোদ্ধাদের , বিশেষ করে হারকিউলেস, কাইরাসের কীর্তিকলাপ শ্রবণে অধিকতর উৎসাহ পেতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে তিনি রাজা ফিলিপের মৃত্যু হলে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি ম্যাসিডোনিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন দিগ্বিজয়ী বীর এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক । সিংহাসনে আরোহণের দু” বছরের মধ্যে তিনি বিরাট এক সেনাবাহিনী নিয়ে দিগ্বিজয়ে অগ্রসর হন । তাঁর সেনাবাহিনী ৩০,০০০ পদাতিক ও ৫০০০ অশ্বারোহী গঠিত ছিল ।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কারণঃ
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল । নিম্নে কারণগুলো আলোচনা করা হলো:
প্রথমত, আলেকজান্ডার ছিলেন একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজা । গ্রিক সাম্রাজ্য বিস্তার ও সামরিক গেীরব অর্জন করাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান স্বপ্ন। ভারতবর্ষে তাঁর সামরিক অভিযান ছিল এই স্বপ্নেরই বাস্তব প্রতিফলন।
দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষ ছিল বিপুল ধন-সম্পদের দেশ । হেরোডোটাস ও অন্যান্য গ্রিক লেখকরা তাঁদের লেখনীতে ভারতবর্ষেকে প্রাচুর্যর দেশ হিসাবে বর্ণনা করেন । সুতরাং, ভারতবর্ষের সম্পদ আলেকজান্ডারকে ভারত অভিযানে যে প্রলুব্ধ করে , তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই ।
তৃতীয়ত, আলেকজান্ডার যখন ভারত অভিযান করেন তখন সিন্ধু উপত্যকা ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ । সুতরাং পারস্য বিজয় সম্পন্ন করে পারস্যের অধীন সমস্ত প্রদেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা আলেকজান্ডার তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেন।
চতুর্থত, আলেকজান্ডার কেবলমাত্র রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্যেই ভারতবর্ষে অভিযান প্রেরণ করেননি। জল ও স্থলপথে ভারতের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন এবং ব্যবসায় বাণিজ্য সম্প্রসারণ করাও ছিল তাঁর অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য । এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক Bury- র মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে । তিনি বলেন, “ Alexander is often represented as a man, impelled by lust of conquest for conquest”s sake. The advance to the Indus was no mere wanton aggression. The solid interests of commerce underlay the ambition of the Macedonian conqueror.”
পঞ্চমত, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা ছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জয় করে সে সব দেশে এই গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানো আলেকজান্ডারের অপর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ।
ষষ্ঠত, আলেকজান্ডারের ছিল তীব্র ভেীগোলিক অনুসন্ধিৎসা । বিভিন্ন দেশ জয়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর মনের এ বাসনা পূরণ করতে আগ্রহী ছিলেন ।
সপ্তমত, উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারকে ভারত অভিযানে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ করে ।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলাফলঃ
মহামতি আলেকজান্ডারের অভিযান ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একথা সত্য যে, আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে মাত্র কয়েকমাস অবস্থান করেন। কিন্তু ভারতে তাঁর স্বল্পকালীন অবস্থান সত্ত্বেও নানা দিক দিয়ে তাঁর আক্রমণ ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে ।
আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে Paul Masson মন্তব্য করেন, “ The importance of the Indian campaigns of Alexander has been both exaggerated and underestimated.”
কোনো কোনো পন্ডিত মনে করেন, আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে ভারত সম্পূর্ণরূপে গ্রিক ভাবধারায়র দিকে ধাবিত হয় । আবার অনেকে মনে করেন, তাঁর আক্রমণ ভারতবর্ষের উপর কোনরূপ প্রভাব ফেলেনি। তবে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় , তাঁর আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফল ভারতবর্ষের ইতিহাসে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না । এ প্রসঙ্গে V. A. Smith যথার্থই বলেছেন, “ Alexander”s fierce campaign produced no direct effect upon the ideas and institutions of India. আলেকজান্ডার ভারতের কিছু অঞ্চলের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম সত্য, কিন্তু তাঁর পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখা সম্ভব হয়নি। সামরিক দিক থেকে তাঁর বিজয় ভারতবাসীকে মোটেই চমৎকৃত করতে পারেনি। এর প্রমাণ ভারতবাসী গ্রিস তথা পাশ্চত্যের সামরিক কেীশল থেকে কোন শিক্ষা না নিয়ে তাদের পুরাতন রণনীতি ও সমরোপকরণেই আস্থাশীল থাকে । উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রিক শাসন তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরেই শেষ হয়ে যায় । ভারতীয় সমাজ, ধর্ম ও শিল্পের উপরও আলেকজান্ডারের আক্রমণ তেমন প্রভাব ফেলেনি। এসব কারণেই হয়ত সমসাময়িক বা পরবর্তীকালে রচিত ভারতীয় সাহিত্য আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের কোনো উল্লেখ নেই । তবুও বিবিধ বিচারে আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলাফলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এই দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রত্যক্ষ ফলঃ
প্রমথম, আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পাঁচটি গ্রিক উপনিবেশ গড়ে ওঠে। আলেকজান্ডার এই উপনিবেশগুলোর ৩ টিতে ভারতীয় গভর্নর এবং ২ টিতে গ্রিক গভর্নর নিযুক্ত করেন। এই অঞ্চলগুলো পরে মেীর্যরা জয় করে সত্য কিন্তু উপনিবেশগুলো একেবারে নিশ্চিহৃ হয়ে যায় নি। চন্দ্রগুপ্ত মেীর্য এবং সম্রাট অশোকের শাসনামলে বহু গ্রিক এসব স্থানে বসবাস করত ।
দ্বিতীয়ত, এই অভিযানের অন্যতম স্থায়ী ফল ছিল প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন। দীর্ঘকাল ধরে গ্রিস ও ভারতবর্ষের সঙ্গে পারস্যের মাধ্যমে যোগাযোগ চলত । কিন্তু এই অভিযানের পর উভয় দেশের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয় । আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলে কাবুল, বেলুচিস্তান ও মারকানের মধ্যে দিয়ে ৩ টি স্থলপথ এবং পারস্য উপসাগরের মধ্যে দিয়ে নতুন একটি জলপথ আবিষ্কৃত হয়।
তৃতীয়ত, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষের প্রাণনাশ হয় এবং বিপুল সম্পদ ধ্বংস হয় । ঐতিহাসিক বিবরণে জানা যায়, এই আক্রমণে এক লক্ষ লোক নিহত এবং দেড় লক্ষ মানুষ আহত ও বন্দী হয় ।
চতুর্থত, আলেকজান্ডার বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়েই এদেশে আসেননি, তাঁর সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক ও ভেীগোলিক ভারতে আসেন। ঐসব ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সন-তারিখসহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের চলমান জীবনধারার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার কর্তৃক ভারত অভিযান প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম তারিখের সন্ধান দেয় । এর পূর্বে ভারত ইতিহাসের কোন ঘটনার তারিখ এত স্পষ্টভাবে জানা যায় নি। এর ফলে মেীর্য রাজাদের সময়ানুক্রমিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে । এজন্য আলেকজান্ডারের অভিযান ভারতের ইতিহাসে “ Sheet anchor” হিসেবে বর্ণনা করা যায় ।