তৈমুর লং -এর ভারত আক্রমণ ।
ভারতের বহিঃশত্রুর আক্রমণের ইতিহাসে তৈমুর লং এর আক্রমণ এক উল্লেখযোগ্যে ঘটনা । ১৩৯৮ সালে তৈমুর লং এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন এবং দিল্লীসহ ভারতের উত্তর-পশ্চিম এলাকা ধ্বংসস্তপে পরিণত করেন।
তৈমুর-লং এর পরিচয়ঃ
ট্রান্স অক্সিয়ানার চাগতাই তুর্কি নেতা আমীর তুরগের পুত্র তৈমুর ১৩৩৬ সালে কেশের সেবজার নামক স্থানে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।পিতার মৃত্যুর পর তিনি ৩৩ বছর বয়সে চাগতাই তুর্কিদের নেতা নির্বাচিত হন । পিতার মৃত্যুর পর তিনি ৩৩ বছর বয়সে চাগতাই তুর্কিদের নেতা নির্বাচিত হন । তাঁর নেতৃত্বে চাগতাই তুর্কিরা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠে ও একের পর এক পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ দলখ করে চাগতাই তুর্কিরা রাজশক্তিতে পরিণত হয়। তাঁর উত্থানে সিজিস্তানের শাসনকর্তা জালালউদ্দিন মাহমুদ শংকিত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। জালালউদ্দিন মাহমুদ বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে তাঁকে পঙ্গু করে দেন। কিন্তু এক পা হারিয়েও তৈমুর নিরস্ত্র হননি। তিনি এ অবস্থাতেও অসীম দক্ষতার সাথে তার বাহিনীকে সুসংগঠিত রাখতে ও আরো শক্তিশালী করতে সক্ষম হন। ১৩৬৯ সালে তিনি তার জীবনের অন্যতহম এক সাফল্য অর্জন করেন সমরকন্দ দখলের মধ্য দিয়ে । তিনি সমরকন্দে স্বীয় রাজধানী স্থাপন করেন। সমরকন্দকে চাগতাই তুর্কেোদর শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করে তৈমুর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের সীমানা মধ্যএশিয়া ব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি ভারতের দিকে দৃষ্টি দেন।
তৈমুরের ভারত আক্রমণের পিছনে একাধিক কারণ ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। যেমন:
১) তৈমুর গোড়া মুসলিম ছিলেন এবং পেীত্তলিকদের ধ্বংস করতে ভারত অভিযান করেন।
২) ভারতরে ধন-সম্পদ হস্তগত করাও তার এ অভিযানের মূল নিহিত ছিল ।
৩) উচ্চাভিলাষী তৈমুর ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতা ও ক্ষয়িষ্ণুতা লক্ষ করে সহজে ভারত বিজয় করা সম্ভব হবে বুঝতে পেরে এ আক্রমণ পরিচালনা করেন।
তৈমুরের ভারত অভিযান:
তৈমুর ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্যে ১৩৯৮ সালে স্বীয় পেীত্র পীর মোহাম্মদের নেতৃত্বে একটি অগ্রবর্তী দল পাঠান। পীর মোহাম্মদ ঝটিকা আক্রমণ করে মুলতান পর্যন্ত দখল করে তৈমুরের আগমনের পথ নিষ্কন্টক করেন। অতঃপর ঐ একই বছর এপ্রিল মাসে তৈমুর এক বিশাল বাহিনী নিয়ে সমরকন্দ থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ভারতের মূল ভূ-খন্ডে প্রবেশ করে একে একে বিভিন্ন নগর ও জনপদ পদানত করতে করতে দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন। ১৩৯৮ সালে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি তৈমুর দিল্লী আক্রমণ করেন। দিল্লীর সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তুঘলক এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তৈমুরের গতিরোধ করতে এগিয়ে যান কিন্তু শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে গুজরাটে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। ফলে অতি সহজেই তৈমুর দিল্লী দখল করেন। ১৫ দিন যাবৎ দিল্লীতে হত্যাযজ্ঞ , ধ্বংস লীলা ও লুন্ঠন চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ, সোনা-রত্ন হাতিয়ে নিয়ে তিনি ফিরে যান। দিল্লী ছাড়াও এক নিকটবর্তী গ্রাম-শহরসমূহও তার হাতে লুন্ঠিত হয় । তাঁর এই আাক্রমণ দিল্লীকে এক নরকপুরীতে পরিণত করে । V.D. Mahajan – এর মতে, “ He ( Timur) had inflicted on India more misery than had ever before been inflicted by any conqueror in a single invasion.
তৈমুরের ভারত আক্রমণের গুরুত্বঃ
তৈমুর লং- এর ভারত আক্রমণ ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । দিল্লী সালতানাত যখন ক্ষয়িষ্ণুতার চরম পর্যায়ে উপনীত তখন এই আক্রমণ ও ধ্বংসলীলা যে সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে তা নিচে আলোচনা করা হলো: –
প্রথমত, তৈমুরের ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লী সালতানাতের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি ধুলায় লুন্ঠিত হয় । সুলতান জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারায় সালতানাতের প্রতি মানুষের আস্তা লোপ পায় ।
দ্বিতীয়ত, তৈমুর ১৫ দিন যাবৎ দিল্লী ও তার আশপাশের এলাকা লুণ্ঠন চালিয়ে দিল্লীকে নিঃস্ব করে চলে যাওয়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ অত্র এলাকার অধিবাসীরা চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে কালাতিপাত করতে থাকে। মোগলদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত রাজকোষাগারের উপরও উহার তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ফলে জনগণ অর্ধাহারে, অনাহারে দিনযাপন করে এক হাহাকার পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে । তৈমুরের তলোয়ার যত না জীবন কেড়ে নেয়, তার চেয়ে অনেক বেশী জীবন কেড়ে নেয় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ।
তৃতীয়ত, তৈমুরের আক্রমণের রজনৈতিক গুরুত্বও ছিল অনেক । নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তৈমুরের আক্রমণ মোকাবেলা করতে না পারায় দিল্লীর অনেক অভিজাত তার উপর ক্ষুব্ধ হয় । তাদের সহযোগিতহায় নুসরৎ শাহ নিজেকে দিল্লীর সুলতান বলে ঘোষণা করে । কিন্তু নাসিরউদ্দিন মাহমুদের সেনাপতি মল্লু ইকবাল মাহমুদকে দিল্লীতে ফিরিয়ে এনে সিংহাসনে পুনপ্রতিষ্ঠিত করেন। তবে তিনি শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা সুদৃঢ় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। ফলে লাহোর, মুলতান ও দিপালপুরস্থ তৈমুরের শাসনকর্তা খিজির খান ১৪১৪ সালে দিল্লী পুনরায় আক্রমণ ও দখল করে তুঘলক বংশের শাসনের অবসান ঘটান।
চতুর্থত, তৈমুরের আক্রমণ ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। বলবন, আলাউদ্দিন খলজী ও মুহম্মদ বিন- তুঘলকের ধর্ম নিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি ঘটে। তৈমুরের ভারত আক্রমণ ও অমুসলিম নিধনের ফলে তাঁদের সে অর্জন তিরোহিত হয়। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়েয়ে পড়ে, যা দীর্ঘস্থায়ী এক বিভেদ-বিসস্বাদ পরিস্থিতিতে ভারতকে ঠেলে দেয় ।
পঞ্চমত, তৈমুর ভারতের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রে ধ্বংস করে দেয় । ফলে দিল্লী তথা ভারতে শিক্ষা -সংস্কৃতির চর্চা দীর্ঘদিন ধরে স্তিমিত হয়ে পড়ে ।
ষষ্ঠত, তৈমুর ভারতে ধ্বংস-যজ্ঞ চালালেও শিল্পকলার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল । তিনি ভারত থেকে অনেক শিল্পী ও ভাস্করদের নিজ রাজধানী সমরকন্দে নিয়ে যান। সেখানে তাদের শিল্পচর্চার মাধ্যমে ভারতীয় শিল্পকলা মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে।
সপ্তমত, তৈমুর ও তাঁর বংশধরদের মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যায় । ভারতে তাঁদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে, যা ভবিষ্যতে ভারতে তৈমুরের বংশধরদের তথা মোগলদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ সুগম করে ।
অষ্টমত, তৈমুরের আক্রমণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁরই বংশধর বাবরকে ভারত অভিযানে অনেক পরিমাণে উৎসাহ ও সাহস যোগায় । মূলতঃ বাবর মনে করতেন, তৈমুরের উত্তরাধিকারী হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে তার দাবী আছে । ফলে পূর্বপুরুষের সিংহাসনের উপর স্বীয় দাবি প্রতিষ্ঠাপ করতে তিনি ১৫২৬ সালে ভারত আক্রমণ ও দিল্লী অধিকার করে সে দাবী প্রতিষ্ঠা করেন ।