বাংলায় নবাবী আমল ।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের পর দিল্লির দুর্বল উত্তরাধিকারীদের সময়ে মুঘল শাসন শক্তিহীন হয়ে পড়ে । এ যুগে বাংলার সুবেদারগন প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন । মুঘল আমলের এ যুগ নবাবী আমল নামে পরিচিত ।
মুর্শিদকুলী খানঃ নবাবী শাসন প্রতিষ্ঠা।
মুর্শিদকুলী খান দক্ষিণ ভারতের একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । দাক্ষিনাত্যের শায়েস্তা খানের দেওয়ান হাজী শফী ইস্পাহানী অল্প বয়সি মুর্দিদকুলীকে ক্রয় করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন । প্রথমে তার নাম রাখা হয় মুহাম্মদ হাদী । একপর্যায়ে তিনি বেরার প্রদেশে দেওয়ান হাজী আব্দুল্লাহ প্রথমে তার নাম রাখা হয় মুহাম্মদ হাদী । একপর্যায়ে তিনি বেরার প্রদেশে দেওয়ান হাজী আব্দুল্লাহ খোরাসানীর অধীনে চাকরি নেন। রাজস্ব আদায়ের কাজে তার অভিজ্ঞতা সম্রাট আওরঙ্গজেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । ১৭০০ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব মুহাম্মদ হাদীকে সম্মানসূচক “ করতলব খান” উপাধি দিয়ে দেওয়ান ( অর্ধমন্ত্রী) হিসেবে বাংলায় পাঠায় । কর্মদক্ষতার গুণে তিনি বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানিও লাভ করেন । এরপর সম্রাট তাকে “ মুর্শিদকুলী খান” উপাধিতে ভূষিত করেন। পরে তার নামানুসারে মুকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে “ মুর্শিদাবাদ” রাখা হয় । সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে পুরো মুঘল সাম্রাজ্যে গোলযোগ দেখা দেয় । এ সময় থেকে তিনিই বাংলার নায়েব এ নাজিম হিসেবে শাসন করতে থাকেন । এরপর বাহাদুর শাহের সময় মুর্শিদকুলী খানকে দাক্ষিণাত্যে বদলি করা হয় । তবে বাংলায় নতুন করে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তাকে মাত্র দুেই বছরের মধ্যে এখানে ফিরিয়ে আনা হয় । তার কর্মনিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়েই সূচিত হয় বাংলার নবাবী শাসন ।
পলাশীর যুদ্ধঃ
তারিখ: ২৩ জুন, ১৭৫৭ , বৃহস্পতিবার । যুদ্ধ শুরু: সকাল ৮ টায় । যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল: ৮ ঘণ্টার মতো ।
নবাবের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মীরমর্দান, মোহন লাল , খাজা আব্দুল হামিদ খান, নবসিং হাজারি প্রমুখের অধীনে নবাব সেনারা । ফরাসি বীর সিনফ্রেও ছিলেন নবাবের পক্ষের অন্যদিকে, মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভ রায়ের অধীনে নবাবের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা নিক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং পরিস্থিতি অবলোকন করে।
সিরাজউদ্দেীলাঃ
জন্ম: ১৭৩৩ সনে । মৃত্যু: ৩ জুলাই ১৭৫৭ । পূর্ণনাম: মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দেীলা । পিতা: জয়েন উদ্দীন । মাতা: আমিনা বেগম । খালা: ২ জন – ঘসেটি বেগম ও মায়মুনা বেগম । নানা: আলীবর্দী খান । স্ত্রী: লুৎফুন্নেছা বেগম। শ্বশুর: ইরিচ খাঁ। কন্যা: উম্মে জোহরা ।
নবাব সিরাজউদ্দেীলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। পাটনা যাওয়ার পথে মীরজাফরের জামাতা ও মীরনের ভগ্নিপতি মীর কাসিমের মাধ্যমে ধরা পড়েন । এরপর মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ৩ জুলাই ১৭৫৭ সালে মোহাম্মদী বেগের ছুরিরাঘাতে নিহত হন । মীর্জা জয়নুল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি নবাব সিরাজউদ্দেীলার লাশ দাফন করেন। নবাব আলীবর্দী খানের “ আনন্দ উদ্যান” খোশবাগের গোলাপ বাগানে নানার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয় ।
পলাশীল খলনায়কেরাঃ
কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রের কারণেই পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন বাংলা- বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দেীলা । পলাশীর ষড়যন্ত্রকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের অন্যতম- মীরজাফর । জগৎশেঠ। মহারাজা স্বরূপচাঁদ । রায় দূর্লভ। উমিচাঁদ । মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র । রাজা রাজবল্লভ । মীর কাসিম । ইয়ার লতিফ খান। মহারাজা নন্দকুমার । মীরন । ঘসেটি বেগম । মোহাম্মদী বেগ । দানিশ শাহ বা দানা শাহ । রবার্ট ক্লােইভ । ওয়াটস। ক্রাফটন । ওয়াটসন ইত্যাদি ষড়যন্ত্রকারী ।
নবাব সিরাজউদ্দেীলার প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীরজাফর আলী খান। তার বিশ্বাসঘাতকতাতেই পলাশীর প্রান্তরে ২০০ বছরের জন্য বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয় । তাই “মীরজাফর” নামটি আজও বিশ্বাসঘাতকের প্রতীক হিসেবে ব্যবহারিত হয়ে থাকে ।
অন্ধকূপ হত্যাঃ
২০ জুন ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দেীলা কর্তৃক কলকাতা দখলের সময় ইংরেজ সেনাপতি জে জেড হলওয়েলের রচিত কল্পকাহিনীেই অন্ধকূপ হত্যা । বলা হয়, ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৪.১০ ফুট প্রস্থের ছোট একটি ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখা হয় । এতে প্রচন্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয় । কল্পকাহিনীতে প্রভাবান্বিত হয়ে ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতা দখল করে । ফলে সিরাজউদ্দেীলা ইংরেজদের সাথে আলীনগর সন্ধি করতে বাধ্য হয় ।
বর্গীদের আক্রমণঃ
বাংলায় বর্গী আক্রমণ বলতে মারাঠা সাম্রাজ্য কর্তৃক ১৭৪২-১৭৫১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ নয় বছরব্যাপী বারবার বাংলা আক্রমণ এবং এর ফলে বাংলার নবাবের সঙ্গে মারাঠাদের সংঘর্ষকে বুঝায় । “বর্গী” শব্দটি মারাটি বারগির শব্দের অপভ্রংশ । বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাতো যারা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবল একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হতো । মারাঠা নেতা ছাত্রপতি শিভাজী কর্তৃক এদের ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করা হতো । শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে বাংলায় মারাঠা আক্রমনের অবসান ঘটে । এ চুক্তির অংশ হিসাবে আলীবর্দী খান বর্গীদের হাতে উড়িষ্যা ছেড়ে দেন ।
শিয়াদের উত্থানঃ
বাংলায় শিয়া মতবাদ প্রচারিত হয় সতেরো শতকের প্রথমভাগে । পারস্যের বণিক ও ভ্রমণকারীরা এ মতবাদ প্রচার করেন। মীল জুমলা ও শায়েস্তা খান এর মতো বিখ্যাত মুঘল সুবাদাররাই ছিলেন শিয়া । বাংলার মুঘল শাসক শাহ্ সুজা সুন্নি হলেও তার মা মমতাজ বেগম ( সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী ) ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী । শাহ্ সুজার আমলেই ঢাকার বিখ্যাত হোসেনী দালান নির্মাণ করা হয় । শুধু তাই নয়, আঠারো শতকের প্রথমভাগের অধিকাংশ নবাবই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত । বাংলায় শিয়া আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ পায় মুর্শিদকুলী খানের আমলে । মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে তিনি বাংলায় কার্যত একটি শিয়া রাজংশ গড়ে তুলেন । যদিও এখানকার মুসলমানদের অধিকাংশই সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত ।
সুজাউদ্দীন খানঃ
১) নবাব সুজাউদ্দীন ছিলেন= মুর্শিদকুলীর জামাতা ।
২) শায়েস্তা খানের পর একমাত্র তার আমলেই বাংলায় ১ টাকায় ৮ মন চাল পাওয়া যেত ।
আলীবর্দী খানঃ
১) আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম= মির্জা মুহাম্মদ আলী ।
২) ১৭৪০ সালে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খানকে পরাজিত করে বাংলার মসনদ অধিকার করেন = আলীবর্দী খান ।
৩) বর্গীয় বাংলায় ব্যাপক অত্যাচার করেছিল = আলীবর্দী খানের সময়ে ।
৪) বাংলায় মারাঠা বা বর্গী দমনে সবচেয়ে বেশি অবদান= আলীবর্দী খানের।
৫) আলীবর্দীর সময়ে বাংলার রাজধানী ছিল= মুর্শিদাবাদ ।
মীর কাসিম ও বক্সারের যুদ্ধঃ
১) পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাংলার নবাব হন= মীরজাফর ।
২) বক্সারের যুদ্ধ হয়= ২২ অক্টোবর ১৭৬৪ সালে ।
৩) বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন= হেক্টর মনরো ।
৪) বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন= মীর কাসিম ।
স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতঃ
পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দেীলা পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজদের গতিরোধ করার মতো শক্তি ও সাহস এদেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহৃ হয়ে যায় । আর তখন থেকেই এদেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে যায় ইংরেজরা; নবাব থাকেন একমাত্র তাদের হাতের পুতুল । বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমের পরাজয়ের পর বাংলা তথা উপমহাদেশে ইংরেজরা দেওয়ানি লাভ করে । মরি কাসিমের নবাবী লাভের আগেই রবার্ট ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কিন্তু ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষ এদেশে কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তাকে লর্ড উপাধিতে ভূষিত করে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলায় প্রেরন করেন । তিনি মুঘল সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বছরে ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব লাভ করেন। এতে বাংলা তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশের পথ উম্মুক্ত হয়ে যায় । শুরু হয় প্রায় ২০০ বছরের লুটপাট আর গোলামির ইতিহাস।
বিগতসালে পরিক্ষা আসা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নঃ
১) বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন নবাব কে? = মুর্শিদকুলী খান ।
২) কোন মুঘল সুবাদার বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন? = মুর্শিদকুলী খান।
৩) পলাশীর যুদ্ধ কবে সংঘটিত হয়েছিল= ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে ।
৪) বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দেীলা কোন যুদ্ধে পরাজিত হয়= পলাশীর যুদ্ধে ।
৫) নবাব সিরাজউদ্দেীলার পিতার নাম কী? = জয়েনউদ্দীন।
৬) ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় কোন নদীর তীরে? = ভাগীরথী ।
৭) নবাব মুর্শিদকুলী খানের বাংলায় শাসনকাল= ১৭১৭-১৭২৭ সাল ।
৮) বাংলায় রাজস্ব ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন= মুর্শিদকুলী খান।
৯) “লুন্ঠন প্রিয় বর্গী” বলা হতো কাদের? = মারাঠি সৈন্যদলকে ।
১০) “বর্গী” শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসেছে? = মহারাষ্ট্রীয় ।
১১) “অন্ধকূপ হত্যা” কাহিনী কার তৈরি? = হলওয়েল ।
১২) মুসলমান শাসনামলে এদেশে এসে অত্যাচার ও লুট করেছে কারা? = বর্গীরা ।
১৩) বক্সারের যুদ্ধ কত সালে সংঘটিত হয় ? = ১৭৬৪ সালে ।