সুলতানী আমলের ইতিহাসের উৎস ।
ইতিহাস তত্ত্ব নির্ভর নয় , তথ্য নির্ভর । অনুমান, ধারণা কিংবা তাত্ত্বিকভাবে ইতিহাস রচনা করা যায় না, এর জন্য আবশ্যক হয় তথ্যের। এ তথ্যই ইতিহাসের উপাদান । এ তথ্য বা উপাদান পাওয়া যায় যে সকল উৎস থেকে তার মধ্যে লিপি, মুদ্রা, সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের রচনা , স্থাপত্য নিদর্শন, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ, সরকারি দলিলপত্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । ভারত উপমহাদেশের প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনা করা খুবই কষ্টকর । কারণ, এ যুগের ইতিহাস রচনার প্রত্যক্ষ উৎসের অভাবে পরোক্ষ উৎস তথা লিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য নির্দশন প্রভৃতির উপর নির্ভর করতে হয় । কিন্তু ভারতে মুসলমানদের আগমন থেকে ইতিহাস রচনা করতে ঐতিহাসিকদেরকে আর পরোক্ষ তথ্যাদির উপর নির্ভর করতে হয় না । কারণ এ সময়ের প্রত্যক্ষ উপাদান প্রচুর । মূলতঃ মুসলমানরা গোড়া থেকেই ইতিহাস রচনা অভ্যস্থ । ইসলামের আবির্ভাব থেকেই মুসলমানদের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষ করা যায় । এ কারণেই Sir, Wolsely Haig বলেছেন, “ The rise of Islam is one of the marvels of history. ভারতে মুসলমানদের আগমনের পরথেকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের অনেক লেখা পাওয়া যায় , যা ভারতের মুসলিম ইতিহাস রচনা সহজতর করেছে । এ সময়ে ইতিহাসের উৎসসমূহ নিচে আলোচনা কর হলোঃ
১) সরকারি দলিলঃ
সরকারি দলিলপত্র ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস । এ সকল দলিল-দস্তাবেজ থেকে সরকার ব্যবস্থা ও সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে জানা যায় । সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা, আইন প্রণয়ন, ভূমিদান, রাজস্বনীতি, সংস্কার কর্মসূচী তথা সার্কিক পরিকল্পনা সরকারি দলিলপত্র থেকেই সঠিকভাবে জানা যায় । সুলতানী যুগেই ভারতে প্রথম দলিলপত্র সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয় । যদিও যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় বা সুলতান পরিবর্তনের সময় অনেক দলিলপত্র ধ্বংস হয়েছে । তা সত্ত্বেও যেটুকু রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে তা দিল্লির সুলতানী যুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।
২) ঐতিহাসিক দলিলঃ
দিল্লীর সালতানাতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের রচনাবলী । সরকারি দলিলপত্র গুরুত্বপূর্ণ উৎস সন্দেহ নেই । কিন্তু এ সকল দলিলপত্র উদ্বার করা কঠিন। সুলতানী আমলের অনেক মুল্যবান দলিলপত্র সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। তাই ঐতিহাসিকদের রচনাবলী উহার বিকল্প হিসাবে গুরুত্ব বহণ করে থাকে । এ সকল ঐতিহাসিকদের অনেকেই সমসাময়িক কালে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে ঘটনাসমূহ প্রত্যক্ষ করে লিপিবদ্ধ করেছেন। অবশ্য তা সত্ত্বেও কোন কোন ঐতিহাসিক সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় পক্ষপাতিত্ব করেছেন আবার অনেকে সুলতানদের আনুকুল্য না পেয়ে সত্যের অপলাপ করেছেন । সামান্য ভ্রুটি থাকলেও ঐতিহাসিকদের রচনা অমূল্য উৎস । নিচে ঐতিহাসিকদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তুলে ধরা হলোঃ
ক) কালিমাৎ তারিখঃ এ গ্রন্থটি ১২৩০ সালে ইবনুল আসির রচনা করেন । মধ্য এশিয়াএবং ঘুর সাম্রাজ্যের সানসায়বানী রাজবংশের উত্থান ও সম্প্রসারনের ইতিহাস সম্পর্কে বহু তথ্য এ গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায় । এ গ্রন্থের তারিখ সমূহ যেমন নির্ভুল তেমনি সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনার যে বিশদ বিবরণ এ গ্রন্থে প্রদান করা হয়েছে তা অন্য কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না।
খ) তারিখ-ই-জাহান শুসা-ই-জুয়াইনীঃ এ গ্রন্থটি ১২৬০ সালে আতা মালিক জুয়ায়িনী রচনা করেন। এয়োদশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্য এশিয়ার ইতিহাসের অন্যতম মূল্যবান দলিল হিসেবে এ গ্রন্থ স্থান পেয়েছে । লেখক হালাকু খানের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন বিধায় মোঙ্গলদের কার্যাবলী ও সরকারি দলিলপত্র তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তা ডকুমেন্টস্ হিসেবে অত্র গ্রন্থে সন্নিবেশ করেছেন। এ গ্রন্থের মূল্যায়ন করতে যেয়ে V.D. Mahajan বলেন, ” His work gives us a detailed and authentic account of the conquests in western Asia.
গ) তারিখ-ই-গাজীদা: এ গ্রন্থটি হামদুল্লাহ মাস্তাফি কুজুয়িনী ১৩২৯ সালে রচনা করেন। গজনী, সায়বানী ও দিল্লীর সালতানাতেরইতিহাস জানার জন্য এ গ্রন্থটি সর্বোৎকৃষ্ট । এ গ্রন্থ সম্পর্কে V.D. Mahajan said, ” The author is valuable so far as he confirms other sources. In some places he gives interesting explanations or details which are not to be found in other authorities.
ঘ) The book genealogies: ফাকবর মাদাব্বির রচিত এবং ডেনিসন রোজ সম্পাদিত এ গ্রন্থটি মুসলিম বিজয় থেকে ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ পর্যন্ত ইতিহাস জানার জন্য একটি মূল্যবান উৎস । মিনহাজ-উস-সিরাজ তার লেখায় এ গ্রন্থটিরকথা উল্লেখ করেছেন ।
ঙ) জুয়ামিনুল হিকায়াৎঃ নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ উফি এ গ্রন্থটির প্রণেতা । তিনি ১২২৭ সালে নাসিরউদ্দিন কুবাচার বিরুদ্ধে ইলতুৎমিসের সামরিক অভিযানের কাহিনীর বিশদ বর্ণনা দিয়ে এ গ্রন্থে তৎকালিন দিল্লীল সালতানাতের সামগ্রিক দিক তুলে ধরেছেন।
চ) চাচ-নামাঃ এর মূল গ্রন্থটি আরবি ভাষায় রচিত । পরে নাসিরউদ্দিন কুবাচার সময় উহা মুহাম্মদ আলী বিন আবু বকর কুফি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন । বর্তমানে এ গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ডি. দাউদ পোটা । চাচ- নামা গ্রন্থ আরবদের সিন্ধু বিজয়ের উপর তথ্যবহুল মূল উৎসরূপে বিবেচিত । গ) তারিখ-ই-গাজীদা: এ গ্রন্থটি হামদুল্লাহ মাস্তাফি কুজুয়িনী ১৩২৯ সালে রচনা করেন। গজনী, সায়বানী ও দিল্লীর সালতানাতেরইতিহাস জানার জন্য এ গ্রন্থটি সর্বোৎকৃষ্ট । এ গ্রন্থ সম্পর্কে V.D. Mahajan said, ” The author is valuable so far as he confirms other sources. In some places he gives interesting explanations or details which are not to be found in other authorities.
ছ) তবকাৎ-ই-নাসিরীঃ এ গ্রন্থটি বিখ্যা ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজ রচনা করেন এবং ইংরিজিতে অনুবাদ করেন রিভার্টি । ১২৬০ সালে রচিত এ গ্রন্থটি First hand Account হিসাবে আমাদেরকে মোহাম্মদ ঘুরীর ভারত বিজয় হতে ১২৬০ সালে পর্যন্ত দিল্লী সালতানাত সম্পর্কিত তথ্যাবলী প্রদান করে । ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ-বিন বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয় সম্পর্কে ইহাই একমাত্র সমসাময়িক গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত । যদিও এ গ্রন্থটি পক্ষপাতহীননয়,তবুও এর মূল্যবান তথ্য এ সময়ের ইতিহাস রচনায় অমূল্য সম্পদ ।
জ) তারিখ-ই-মুহাম্মদীঃ এ গ্রন্থটি মোহাম্মদ বিহামাদ খানি রচনা করেন।